বেদনাময় সময়ের ভীড়ে

ঝিক্-ঝিক্...ঝিক্-ঝিক্...করে ট্রেন চলছে দৃশ্যমান গতিতে আর আমার জীবন চলছে অদৃশ্যমান গতিতে--যে গতির গতিময়তা কখনো আমি উপলব্ধি করি না--করতে পারি না ট্রেনের কামরায় বসে আধবোজা  চোখে অনুপম সেনেরকল্পনাউপন্যাসের নায়ক স্বকল্পের নিজের মতামত পড়ছি লেখকের প্রতিটি কথা সমুদ্রের এক একটি ঢেউ এর মতো আছড়ে পড়ে আমার বুকে জীবনের অনেক মিল রয়েছে স্বকল্প আর আমার ব্যর্থময় জীবনের প্রতিটি ধাপে ধাপে বয়স ছত্রিশের ঘরে পৌঁছলেও বিয়ে করা হয়নি আজ অবধি নীড়হারা পাখি সব হারিয়ে ক্লান্ত মনে যেমন করে ভাবে, তেমনি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ শরীরটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো ট্রেন থামছে কোন এক অচেনা স্টেশনে জায়গাটির নাম মনে নেই ট্রেন থামার সাথে সাথেই আরো তিন জন মানুষ একই কামরায় উঠল তিন জনের মধ্যে একজন চল্লিশ-পয়তাল্লিশ বছর বয়স্ক পুরুষ, এক জন তিরিশ-পয়ত্রিশ বছর বয়স্ক স্ত্রীলোক, আরেক জন দশ-এগার বছরের বালিকা

পুরুষ লোকটির মাথায় সামান্য কিছু চুল আছে, তাও পিছনে ন্যাড়া মাথা ঢাকতে তার মাথার পিছনের সামান্য কিছু চুল চিরুণী দিয়ে এমনভাবে আঁচড়িয়েছে--যা দেখেই আমি মুচকি হাসতে লাগলাম কিন্তু সেই হাসি মুহুর্তের মধ্যে বেদনাময় সময়ের ভিড়ে তীব্র বেগে ছুটে চলল স্ত্রী লোকটির মুখের দিকে চোখ পড়তেই সাত আর চার দুটি অংক আমার মাথার উপর বজ্র বিদ্যুতের মত গর্জে উঠলো ভুল দেখছি নাতো? বনিয়াকে মনে হলেই মনে পড়ে, অনেক বেদনার স্মৃতি আজ এত বছর পর আমার এত নিকটে! বনিয়া? নাকি বনিয়ার সাদৃশ্য কোন নারী? আমি তো জানি, বনিয়া সৌদি আরব চলে গেছে অনেক আগে তবে...

চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল৭৪! আজও আমার হৃদয় কেঁপে উঠে সে দিনগুলোর কথা মনে পড়লে হতভাগী মা আমার, আজ আর নেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছে আমার ছোট বোন বাবা আর কোনদিন ফিরে আসেনি৭১ এর অন্ধকার থেকে বড় মামা পঙ্গু আর অর্ধ উন্মাদ হয়ে তার বন্ধুর সাহায্যে গ্রামে ফিরে আসে চার বছর পর মা তখন ছিলেন এক উঁচু ঢিবির শিমূল তলায় চিরশায়িতা দাদী আর ফিরে আসেনি রিলিফের গম নিয়ে নুনের দাম আর অভাব সেদিন কলমি শাকের স্বাদ পেতে দেয়নি কি দুঃসহ অভাব ছিল আমাদের জীবনে! দরিদ্র ছিলাম কিন্তু এমন অভাব কোনদিন ভোগ করিনি কারো কারো বাড়িতে গমের বস্তা ইঁদুরে খায়, কারো চুলায় জ্বলে না এক টুকরো আগুন কারো মুখে খৈ ফুটে রাজাকার আর আলবদর বিশেষণের গালি, কারো মুখ ভাতের মাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকে ১৩৫০ বঙ্গাব্দের মৃত্যুক্ষুধার মত হ্যাঁ, সেদিন আমরা দুভাই দুজন মায়াময় হৃদয়ের স্পর্শে বেঁচে গিয়েছিলাম সেই দুটি মানুষ আজো জীবিত আছে আমাদের দুই ভাইয়ের জীবন সত্তার মাঝে বাস্তবে রিয়াজ চাচা নেই; হয়তো স্বর্গের সুখ নিয়ে স্বর্গের মাঠে জনসেবায় আত্মনিমগ্ন হয়ে আছেন চাচী আম্মা হয়তো আজো বিছানায় গড়াগড়ি যাচ্ছে মৃত্যুর বিষ বায়ু পান করার  জন্যে বাবার সাথে রিয়াজ চাচার কথা হয়েছিল আমাকে ডাক্তারী পড়াবেন কারণ আমি খুবই ভাল ছাত্র দুদুবার বৃত্তি পেয়েছি আর চাচী আম্মা আর আমার মা জেদ ধরেছেন বনিয়াকে আমার সাথে... একটা যুদ্ধ, অসংখ্য মৃত্যু, একটা স্বাধীনতা--সবকিছু পাল্টে দিল

মনে পড়ে৭১ এর যুদ্ধ বাবা ছিলেন কমরেডজন্ম থেকেই দেখছি গ্রামের কৃষক-মজুর-ছাত্র-যুবকদের নিয়ে মিটিং করতে আর মিছিল এর সাথে দৌঁড়াতে   মার্চে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে নিজেদের দলের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনা শেষে দলের সবাই গেরিলা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেয় অস্র সংগ্রহের জন্য ২৫ শে মার্চ বাবা ছিলেন পুরান ঢাকার নবাবপুরে, তার দলের এক কর্মীর বাসায় পাকিস্তানী সৈন্যদের ঢাকা আক্রমণের রাতেই বাবা গ্রামে চলে আসেন রিয়াজ চাচার কাছে আমাদের রেখে মামাকে নিয়ে চলে গেলেন পাকিস্তানী সৈন্যদের হত্যা করার জন্য

বনিয়া থাকত নানার বাড়িতে নানা ছিল হিংস্র আর বদমেজাজী সে তার আভিজাত্য আর ধন সম্পদের খুবই বড়াই করত বনিয়ার নানা আর খালা-মামারা আমাকে সহ্য করতে পারত না অথচ তাদেরই বাড়ি থেকে খাবার এনে চাচা আর চাচী যা করেছেন, তাদের ঋণ কবে শোধ করব? কোনদিনই পারব না একদিন রাতে টুপি-দাঁড়িওয়ালা, কারা যেন বনিয়ার নানাকে ধরে নিয়ে যায়, অথচ যুদ্ধ শেষে তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন একবারে হজ্বযাত্রী হয়ে

বনিয়ার মা আমাকে খুব আদর করত দুর্ভিক্ষে বনিয়ার ভূমিকা প্রেমিকা নয় বরং স্ত্রীর মত ছিল যদিও তাকে নানার অনেক বকুনি খেতে হয়েছে কারো মুখে শুনেছিলাম, বনিয়ার মা প্রেম করে বিয়ে করেছেন রিয়াজ চাচাকে রিয়াজ চাচা তাদের বাড়িতে প্রাইভেট শিক্ষক মানে জাইগীর ছিলেন সে যাই হোক, আমি বনিয়াকে ভালবাসি, বনিয়াও আমাকে... দুর্ভিক্ষের সময় যখন নিজেদের ক্ষেতের কাজ করে বাড়ি ফিরতাম তখন বনিয়াই আমাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিত বাবার শোকে শোকে মা-দাদী দুজনেই বেহেস্তবাসী হলেন বনিয়া মায়ের আর দাদীর শূন্যস্থান অনেকটা পূরণ করতে পেরেছিল একদিন ওর মদখোর মামা জোর করে আমার বুক থেকে বনিয়াকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল বনিয়া পরম শান্তিতে কান্নার্ত চোখে ওর অভ্যাস মত আমার বুকে তখন স্বপ্ন আঁকতে ছিল ভবিষ্যতের সব স্বপ্ন৭৪ এর পর থেকে ভাঙ্গতে শুরু করল


অনেক বেদনার পথ পার হয়ে৭৬ সালে কলেজে ভর্তি হলাম অতি কষ্টে পঙ্গু মামা আমাদের জন্যে খাবার আর অর্থ যোগাড় করতে লাগলেন সারাদিনে মামা কতটুকু খেতেন জানি না তবে আমার সামনে তাকে কখনো খেতে দেখিনি একদিন রাতে কান্নার্ত চোখে আমার মাথায় হাত রেখে বলল, কামাল, তোর বাবাকে আমি কথা দিয়েছি তোদেরকে বাংলার বুকে মানুষ করে তুলব মাস্টার দা, ক্ষুধিরাম, আসাদ--এদের রক্ত, এদের কণ্ঠস্বর, আদর্শ তোর মাঝে দেখতে পাই যুদ্ধ শুধু পাকিস্তানীদের সাথেই হয়নি; হয়েছে, এদেশের রাজাকার, আলবদরদের সাথেও তোর বাবাকে হত্যা করেছে এদেশের রাজাকাররা মামা স্কেচের উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে একটি পুরাতন ট্রাংক বের করলেন খাটের নিচ থেকে চোখে তার পানি, হাত কাঁপছে চাবি দিয়ে ট্রাংকের তালাটি খুলেই বের করলেন একটা ষ্টেনগান যুদ্ধের সময় মামা আমাকে অস্ত্র চালানো ভালভাবে শিখিয়েছিলেন কিন্তু মায়ের শত বাধার কারণে তিনি আমাকে যুদ্ধে নিতে পারেননি অস্ত্রটি আমার হাতে দিয়েই বললেন, ‘ধর আমার সাথে, বল, আর একটা যুদ্ধ চাই; যে যুদ্ধের গর্ভ থেকে জন্ম নেবে আমার মা, আমার বাবা--আমার সত্যিকারের স্বাধীনতা সেদিন মামার কথা এতটা উপলব্ধি করিনি মামা কলেজ জীবন থেকেই রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন পঙ্গু হবার পর থেকে পাগলের মত প্রায়ই বিড়বিড় করে বলতেন, ‘কি চেয়েছিলাম, কি পেলাম, সবই হারালাম...

চোখের তীর বেয়ে অবুঝ বালিকার মত অশ্রু ঝরতে ঝরতে যখন অশ্রুধারা আমার বুকের উপর ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরতে লাগল তখন টের পেলাম, আমার চোখ তার নিজের ভাষায় কথা বলছে চোখ বলছে, তাকিয়ে দেখ, বনিয়া কাঁদছে সত্যিই তাকিয়ে দেখি বনিয়া কাঁদছে মেয়েটি বনিয়ার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে পুরুষটি অন্য পাশে নিজের সীটে হেলান দিয়ে এমনভাবে ঘুমাচ্ছে, যেন কত রাত সে ঘুমায়নি বনিয়া কান্নার্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে নিজেকে কেমন জানি অপরাধীর মত মনে হচ্ছে আজ মনে পড়ে, শ্রাবণের সেই বিকেল বেলার কথা বনিয়া হাস্যোচ্ছলে বলেছিল, আমাদের ভালোবাসা দেখে আকাশ কাঁদছে
--মানে, বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি?
-- আরে না, আকাশ এর বুকে যে বড় দুটি চোখ আছে--সে চোখ দিয়ে কাঁদছে
-- কেন? কাঁদছে কেন?
-- তোমার আমার প্রেম দেখে আমি তোমাকে পেয়েছি কিন্তু শ্রাবণ শর্বরী আকাশ তার প্রিয়কে এখনো পায়নি তার প্রিয় তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে শ্রাবণ আকাশ সাড়ে চারশ কোটি বছর ধরে অপেক্ষা করছে কিন্তু প্রিয় আসছে না
--বাঃ! কোন উপন্যাস থেকে মুখস্থ করেছ? নিশ্চয়ই অনুপম সেনের সুদীর্ঘ অপেক্ষার পর?
   বনিয়া নিজের হাতের বইটি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বলে উঠল,
--তুমি আমাকে কত ভালবাস, অথচ আকাশ সেই প্রিয়তমের কাছ থেকে এক টুকরো ভালোবাসাও পায়নি কত দুঃখ আকাশের, তাই না? আকাশ তোমার জন্য কাঁদছে মেয়েরা সাধারণত ভালোবাসা পাওয়ার জন্যে কাঁদে, তবুও মুখ ফোটে কিছু বলে না পুরুষরা পাথর--
 কথার আর শেষ করতে দেইনি আমি বনিয়ার চোখে চোখ রেখে বলতে লাগলাম,
--বনিয়া, পুরুষরা কাঁদে, তবে কম কিন্তু তুমি যেদিন আমাকে কষ্ট দেবে, সেদিন দেখবে, পাথর ভাবছ? এই পাথরও আকুল হয়ে কাঁদবে
  বনিয়া কেঁদেছিল কেন  কেঁদেছিল--তা  বুঝতে পারিনি তারপর আমার বুকে মাথা রেখে বলল,
-- তোমাকে আমি...
হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে হাসি দিয়ে বলল,
-- জ্বি না সাহেব ব্যাপারটা হল রকম, যখন আকাশ কাঁদে মানে বৃষ্টি ঝড়ায় তখন কান্নার্ত মেয়েরূপী মনে হয় আবার চৈত্র মাসে পুরুষের মত মায়াহীন হয়ে যায় তাহলে বুঝতে পারছ এখন সে আকাশী, চৈত্র মাসে আকাশ
-- তাহলে এখন আকাশী ভালবাসে আমাকে আর চৈত্র মাসে আকাশ ভালবাসে তোমাকে
দীর্ঘ এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বনিয়া গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বলল,
--বাস্তবে আকাশ শুধু ভালোবাসা দিয়ে যায়--ভালোবাসা পায় না--নিতেও চায় না
আমি দক্ষিণের জানালায় গিয়ে আনমনে গান গাইতে শুরু করলাম--‘কখন, কোথায়, কবে, কোন তারা ঝরে গেল আকাশ কি মনে রাখে...

ট্রান্সফারের ফাইলপত্র নিয়ে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিতে যাচ্ছি মনে হচ্ছে, আমার সারা জীবনের কৃতকর্মের ফল নিয়ে রোজ হাসরের ময়দানে  রওনা হচ্ছি ভাবতেও পারিনি বনিয়ার সাথে আর কোনদিন দেখা হবে হয়তো ভুলেই গিয়েছিলাম, পৃথিবীটা যে গোল আজ কেন এমন লাগছে? দুঃখ কি শুধু হৃদয়ের? তবে চোখ কাঁদে কেন? হাত-পা কেন আজ অবস হয়ে আসছে? মাথা কেন এত ভার হয়ে যাচ্ছে? চৌদ্দ বছর পর কেন আজ দেখা হল? খুব জানতে ইচ্ছে করে, বনিয়া কেমন আছ? চোখের আকার একটুও বদলায়নি গালে এখনো টোল পড়ে আছে ঠোঁটের নিচে তিলের দাগটা আজো উঠাতে পারনি আমাকে দিয়ে কত চেষ্টা করেছিলে দাগটা উঠানোর জন্য্য দাগটা দেখতে তোমার খুব খারাপ লাগত আয়নায় মুখ দেখে তুমি কাঁদতে জীবনের প্রতি মুহুর্তের গল্প বিকেলের স্নিগ্ধ রোদের আলোয় বসে আমাকে শোনাতে এত কথা তুমি বলতে যে, আমি আমার কথা তোমাকে শোনাতেই পারতাম না সন্ধ্যা হলে চুপটি করে আমার বুকের উপর ঘুমিয়ে পড়তে বাড়িতে যাবার কথা বললে, বলতে, এইতো আমার বাড়ি তোমার দেহটা হচ্ছে আমার বিছানা আর বুকটা হচ্ছে আমার বালিশ

আজ কেন এত নীরব বনিয়া? শয্যারত মেয়েটা শীতে জড়সড় হয়ে আছে সেদিকে সামান্য দৃষ্টিও নেই কি ভাবছে আমার দিকে চেয়ে? হঠাৎ বুকের অন্তর্ভাগ জুড়ে বুলেটের মত কি যেন নড়ে উঠল উহু! একটা অসমাপ্ত শব্দে চলন্ত ট্রেনের কামড়াটি যেন শনশন করে উঠল মাথাটা ঘুরছে মনে পড়ে, সেই স্টেনগানটির কথা ১৯৭৭ সাল বনির দাদা সাচ্চা আলবদর, আমাদের জমি জমা কেড়ে নিল কোন আমলে আমার দাদার সাথে তার কি হিসেব ছিল তার জের স্বরূপ, সে আমাদের উঠানোর চেষ্টায় সারাদিন পিছনে লেগে থাকত হেমন্তের গোধূলী বেলা বনিয়ার গায়ে হলুদ আমার বনিয়ার বিয়ে হতে যাচ্ছে যাকে একদিন না দেখলে আমি ঘরে থাকতে পারিনি, যে আমাকে একদিন না দেখলে ঘরে থাকতে পারেনি আজ তার বিয়ে৭৭ সালের পর থেকে বনিয়া আমাকে একটু একটু করে পর করে দিচ্ছে আমি টের পাচ্ছি সে আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে গত দশ দিনে একবারও বনিয়া আমার সাথে দেখা করেনি টেবিলের উপরে মাথা রেখে চুপ করে আছি বনিয়ার দাদা মামার কাছে অনেক কিছু বললেন আমি কোন শব্দ করিনি মামাও চুপ করে আছে কিছুক্ষণ পর কিছু লোক এসে মামাকে ভয় দেখাতে লাগল বনির দাদা আমার বাবার সম্পর্কে খারাপ কিছু বলতেই মামা প্রচন্ড রেগে গেলেন মামা চিৎকার করে বলে উঠলেন, শালা আলবদর, রাজাকার, বেঈমান হঠাৎ বনিয়ার দাদা মামার গালে চড় মারলেন মামা হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলেন আমার বুকে সত্যি যেন সূর্য্য সেনের রক্ত বইতে লাগলো আলবদর আমার সামনে এসে বলতে লাগল, ‘বনিয়ার বিয়ে ভুলেও যেন, বাড়িতে পা না পড়ে বনিয়ার সাথে কোন কথা বলার চেষ্টা করবে না

সে দিন আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো স্টেনগান যুদ্ধের সময় মামা নিপুণ হাতে শিখিয়েছিল কিভাবে চালাতে হয় পরের দিন দুপুর বেলা, গ্রামের সভ্য নব্য নেতাদের নিয়ে বনিয়ার মদখোর, জুয়ারি মামা আমাকে কড়াভাবে শাসিয়ে গেল, যাতে বনিয়ার বিয়েতে অসুবিধার চেষ্টা না করি কবে বনিয়াকে বরপক্ষ দেখতে এলো কিছুই জানলাম না বনিয়া কোনদিন আমাকে জানায়নি মনে পড়ে, সেই কথাটি, বাস্তবে আকাশ শুধু ভালোবাসা দিয়ে যায়--ভালোবাসা পায়ও না--নিতেও চায় না কেন বনিয়া কেন? এমন হয় কেন? তুমি কি আকাশ? স্বাধীনতার মূর্তির মত সটান হয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আছি দূর থেকে কানে ভেসে আসছে বেদনার্ত হৃদয়ের তীর ছুঁয়ে যাওয়া একটি গানমুছে যাওয়া দিনগুলো...

রাত দশটা মামা দুটি ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস ভরলেন রাতেই মামা, আমি আর ছোট ভাই দরজা খুলে অশ্র ভরা নয়নে আল্লাকে স্মরণ করে হাঁটতে লাগলাম অজানা-অচেনা কোন এক জায়গায় যেখানে আমাদের কেউ চিনে না মামা অস্ত্রটির কথা বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন আমার কাঁধে তার ক্লান্ত হাতের ছোঁয়া অনুভব করলাম চোখ ভরা প্রতিশোধের আগুন বিগলিত আত্মার অগ্নিগর্ভ থেকে অস্পষ্ট ভাষায় বললাম, মামা তুমি যাও--আমি আসছি

মামা পাগলের মত আকাশের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তারপর আমার দিকে তাকিয়ে স্কেচের উপর ভর দিয়ে সোজা হাঁটতে লাগলেন হঠাৎ তার পরে যাওয়ার শব্দ শুনলাম দৌঁড়ে তাকে মাটি থেকে তুললাম মামার কাঁধে হাত দিয়ে বললাম, মামা তুমি হাঁটতে থাক, আমি আসছি উঠান থেকে একটি ইট কুড়িয়ে নিয়ে দ্রুত ঘরে ঢুকলাম ট্রাংকটা বের করে ইট দিয়ে তালাটা ভাঙ্গলাম বের করলাম স্টেনগান রকম আরেকটা স্টেনগান এখনো সচল আছে মামার সেই বন্ধুর কাছে, যিনি মামাকে যুদ্ধের চার বছর পর বাড়িতে ফিরায়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন গুলি ভরলাম তারপর দৌঁড়ে গেলাম বনিয়াদের বাড়ির দিকে ওদের বাগানের ঝোপে চুপ করে লুকিয়ে রইলাম বাগানের পাশে বনিয়ার নানা আর একজন কি যেন আলাপ করছে আলবদর হাত দিয়ে দেখাচ্ছে আমাদের বাড়ি, মদন দাসের বাড়ি, নুরু মিয়ার বাড়ি পাশের লোকটা নিশ্চয়ই মদখোর বনিয়ার মামা হবে গত দিনের কথা মনে পড়লো মনে পড়লো বিভৎস৭১ এর কথা, ’৭৪ এর  মৃত্যুক্ষুধা আর শ্রেণীশত্রু খতমের শ্লোগান তারপর সব উলট--পালট হয়ে গেল 
 

 হাসপাতাল বেড সিটে শুয়ে মনে করতে লাগলাম, আমার কি হয়েছে? আমি এখানে কেন? বুঝতে আর বাকি রইল না, যখন আমার চোখ বরাবর পুলিশদের দাঁড়ানো দেখলাম নার্স এসে আমাকে বিছানা থেকে একটু উঠাতেই আমি কঁকিয়ে উঠলাম বাম পায়ের হাঁটুর নিচটা এত ভারি কেন? প্লাস্টার করা পা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিল, ‘তুমি৭১ এর আঘাত৭৭ সয়েছ কেন? ব্যথায় ঘৃণায় লজ্জায় সারা ওয়ার্ড কম্পিত করে সে দিন চিৎকার করে ডাকলাম--মা, বাবা!  মামা! বনিয়া! জানি না, নক্ষত্র কুঞ্জে আমার চিৎকার পৌঁছাল কিনা তবে আমার বিশ্বাস, বনিয়া আর আমার হাতে লাগানো বকুল গাছটার সব ফুল নিশ্চয় ঝরে গেছে আমার ডাকে কেউ এলো না সেদিন মা, বাবা, বনিয়া--এরা কোনদিন আর আসেনি আমার জীবনে যা হারিয়ে গেছে--তা চিরতরেই হারিয়েছি  ওয়ার্ডের সব রোগী অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দুইজন কনস্টেবল বাহুর জোরালো শক্তি দিয়ে আমাকে উঠিয়ে নিল আমি অনড় পাথর হয়ে গেলাম গাড়িতে করে আনা হল কোর্টে গিয়ে দেখি কাঠগড়ায় মামা দাঁড়িয়ে আছে আমাকে নিরাপদ স্থানে বসান হল একজন নার্স আমার সাথেই ছিল আমি ডাকলাম, মামা... মামা মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘কোন ভুল করিসনি কামাল, আমি ভুল করেছি, তোর বাবা ভুল করেছে তুই ঠিক কাজ করেছিস তবে রিয়াজ ... থেমে গেল মামার কথা সব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না চোখের আশে-পাশে সাদা কাপড় পেঁচানো বাম হাত গলায় সাথে সমকোণে ঝুলে আছে বুঝলাম আমার সারা দেহের উপর দিয়ে সে রাতে৭১ বয়ে গিয়েছিল মামা আর উকিলের কথোপকথনে বুঝতে পারলাম, আমি বনিয়ার নানা আর রিয়াজ চাচাকে খুন করেছি কাঁদতে লাগলাম চাপা কান্নায় তাহলে ওই লোক মদখোর মামা ছিলেন না? রিয়াজ চাচা! হায়! আমি কি করলাম, কি করলাম! এজন্যই হয়তো বনিয়া আমাকে দেখতে আসেনি উকিল আইনের ভাষায় মামাকে ক্রমাগত প্রশ্ন করতে লাগল,
--আপনি কেন সরকারের হাতে অস্ত্র জমা দেননি আপনি তো জানতেন, অবৈধ অস্ত্র রাখা আইনের চোখে অপরাধ
--জানতাম কেন জমা দেব? ’৭১ আমাকে কি দিয়েছে? আমি মুক্তিযোদ্ধা, ঘৃণা করি ভাবলে আমি স্টেনগান ছাড়া৭১ এর মহাকাল থেকে কিছুই আনতে পারিনি পারিনি কামালের বাবাকে ফিরিয়ে আনতে পারিনি ওর মাকে বাঁচাতে পারিনি ওদের পড়াতে, খাওয়াতে অস্ত্র ছাড়া আমি কামালকে কিছু দিতে পারিনি আপনারা যারা মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সাহায্য দেন, তারা বলেন, ’৭১-- আপনারা কে, কোথায় ছিলেন?  সেদিন রিলিফ অফিসে গিয়ে দেখি আলবদরেরা কাজ করছে আমাকে দেখে বলছে, আমি নাকি দেশের বোঝা স্বরূপ   

মামা কাঁদছেন শ্রাবণের আকাশের মত কখনো আমার দিকে, কখনো উকিলের দিকে, কখনো জজের দিকে পাগলের মত তিনি তাকাচ্ছেন কি যেন ভেবে আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি দূর থেকে আলবদর আবুল কালামকে গুলি করেছি কিন্তু রিয়াজ ভাইকে মারতে চাইনি টার্গেট মিস্ ওরা আমাকে ধরতে না পেরে বাড়ি থেকে কামালকে ধরেছে ওকে৭১ চেয়েও নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া হয়েছে

 আমি চিৎকার করে উঠলাম আহ্! উহু! শব্দে সারাটা দেহ ভেঙ্গে পড়তে লাগলো মুখ হতে আর কোন শব্দ বের হলো না পাথর চোখে সব দেখতে পেলাম, সব শুনতে পেলাম কিন্তু এক টুকরো শক্তি ছিল না বলতে যে, আমি অপরাধী নার্স  এসে আমাকে ধরলেন মামার কান্নার্ত ধ্বনিতে পুরো আদালত প্রতিধ্বনিতে গর্জে উঠল--‘হ্যাঁ, হ্যাঁ আমি অপরাধী; কারণ আমি মুক্তিযোদ্ধা, আমি দোষী, কারণ আমি যুদ্ধ করেছি আমি পাপী, কারণ আমি একজন বেঈমান, দেশের শত্রুকে খুন করেছি আমি দোষ স্বীকার করছি আমি নির্দোষ রিয়াজ ভাইকে খুন করেছি আমি দেশের জন্যে, স্বাধীনতার জন্য বিদ্রোহ করেছি মিছিল করেছি, যুদ্ধ করেছি আর কোন শব্দ শুনতে পেলাম না মামা জ্ঞান হারিয়েছেন
   
 পরবর্তী ঘটনাঃ আমরা দুই ভাই মামার বন্ধুর বাড়িতে মানুষ হতে লাগলাম পরে বছর মামা জেলে থাকাকালীন অবস্থায় পায়ের অসহ্য যন্ত্রনা আর না পাওয়ার বেদনা নিয়ে মারা গেলেন পুলিশ কর্তৃপক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা অনেক চেষ্টা করেছেন মামাকে বাঁচানোর  জন্যে মামা বাঁচেনি অনেক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাহায্য করতে চেয়েছেন বাবার সহকর্মীরা সবাই আমাদের দেখতে আসে, সাহায্য দিতে আসে কিন্তু মামার বন্ধু একটি সাহায্য কোনদিন ছুঁয়েও দেখেননি, আমাদেরও ছুঁইতে দেননি
নতুন করে৭৮ সালে জীবন শুরু হলো তারপর... থাক... ট্রেনের কামড়ায় বসে আর ভাবতে ইচ্ছে করছে না ট্রেনের এই কামরা আজ অনেক বছরের পুরাতন স্মৃতিকে জীবন্ত করে দিয়েছে ঘন ঘন নিঃশ্বাস বয়ে যাচ্ছে ক্লান্ত হয়ে গেছি ভাবতে ভাবতে বনিয়া হয়তো আজও রেগে আছে তার বাবাকে খুন করেছি বলে সে এখন অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে কি যেন ভাবছে সামান্য সাহসও আমার নেই যে, ওর সাথে কথা বলি

আজ যদি বনিয়া কথা বলতো, তাহলে নিশ্চয়ই জানতে চাইত বিয়ে করেছি কিনা? ছেলেমেয়ে জন? আমিও ঠাট্রা করে বলতাম, করেছি এবং একজন--সে হল, আমি আমি আমার সন্তান তারপর হয়তো হাসতাম সেকি আজ, এখন, সম্ভব? বিয়ে, হ্যাঁ বিয়ে, আমি তো আর হিজরা নই, পুরুষ  হয়ে জন্মেছি বিয়েতো করতে হবেই আর না করলেই বা কি? যেভাবে আমার জীবন চলছে, তাতে জীবনের এই বেদনাময় সময়ের ভীড়ে আপনজনের সংখ্যা আর না হয়, নাই বাড়ালাম জীবন কারো জন্যেই থেমে থাকে না! কোনমতে চললেও  চলে ট্রেন থেমে গেল বনিয়া মেয়েকে জাগালো তারপর দুই যাত্রীর জীবনে যা ঘটে, একজন নেমে যায়--অন্যজন থেমে থাকে আগে পরে তাকেও নামতে হবে আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম কোন কথা বলল না বনিয়া কোথায় যাচ্ছি, কেমন আছি, কোন প্রয়োজন বোধ করল না আমি কি এতই অপরাধী যে, আমার সাথে একটি কথাও বলবে না কি লাভ? হ্যাঁ, কি লাভ হৃদয়ে ঝড় তুলে?

সবার পিছনে বনিয়া নামল হাত উঁচু করে অস্পষ্টভাবে বলল, ‘বিদায়... সুদীর্ঘ এক নিঃশ্বাস! বিদায়! চোখ ভারী হয়ে এল আমারআসি না বলেবিদায় কেন? তবে কি আর কোনদিন দেখা হবে না এই কি চিরবিদায়, এই কি শেষ দেখা! আমি ডান হাত উঠিয়ে জানতে চাইলাম, বনিয়া কেমন আছ? কিন্তু ততক্ষণে বনিয়া নেমে গেছে ট্রেন আবার চলছে চারিদিক অন্ধকার আমি চিৎকার করলাম--‘বনিয়া কেমন আছ, কোথায় যাচ্ছ?’ বাতাসে সব ধ্বনি মিলিয়ে গেল কোন উত্তর এল না হৃদয়ের বেদনাকুঞ্জ থেকে ধ্বনিত হচ্ছে একটি গান--“হাজার মনের কাছে প্রশ্ন করে, একটি কথাই শুধু জেনেছি আমি...

বৃষ্টি ঝরা কালো আকাশ, রাতের আঁচলে ঘন ঘন চোখ মুছছে মনে হয়, এই বুঝি আকাশ ভেঙ্গে পড়বে কঠিন এই পৃথিবীর বুকে ট্রেন চলছে আর বলছে, “আমি থেমে থাকি না আমি চলি যখন যেখানে যতটুকু থামতে হয়, ততটুকু থামি, আর ফিরে তাকাই না পিছু আমাকে অনুসরণ কর, তুমিও জীবনের সামনের পথগুলো পার হতে পারবে অনায়াসে মেঘের ফাঁকে চাঁদ উঁকি দিয়ে আমাকে বলছে, “বনিয়া চলে গেছে, থেমে থাকেনি এই দেখ, আমিও চলছি তোমাদের পৃথিবীর চারপাশে আমি স্থির নই তুমি কি মনে কর, বনিয়া তোমার স্মৃতি স্মরণ করে থেমে থাকে? মোটেই না তোমার দুর্বলতা

আমি বনিয়াকে পেয়েছি বনিয়া আমার কাছেই আছে নীল আকাশ সেতো কাছেই মিছামিছি কেন তাকে ছুঁতে যাব ডায়াজিপাম এর শান্ত ভালোবাসায় আমি একটু পরেই ঘুমিয়ে যাব চোখের প্রান্ত ছুঁয়ে ঘুমের স্নিগ্ধ শীতল পরশ আমাকে বুঝিয়ে দিবে কিভাবে সব ভুলতে হয়, অন্ততঃ ক্ষণিকের জন্য তারপর আবার জাগব আবার ঘুমাব সারাদেশ অশান্ত হয়ে উঠলেও ঘুমের ওষুধের নীরব ছোঁয়ায় সব ঘুমিয়ে যায় যেমন ঘুমিয়ে গেছে৪৭, ’৫২, ’৬৯, ’৭১ আর৯০--তেমনি সব ঘুমিয়ে যায়, সব ...